কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) 'উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. হুমায়ুন কবিরের পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে নতুন বৈষম্য সৃষ্টির প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ' শিরোনামে 'সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষ' থেকে একটি আবেদনপত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. মুজিবুর রহমান মজুমদারের নিকট জমা দেয়া হয়েছে।
তবে সে আবেদনপত্রে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ২৬ জন স্বাক্ষর করে তবে যারা স্বাক্ষর করেছেন তাদের মাঝে কয়েকজন জানেন না তারা স্বাক্ষর করেছেন, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভাগ বা ব্যাচে স্বাক্ষরকারী নামে শিক্ষার্থীই নেই বলে জানা যায়। এছাড়া স্বাক্ষরিত কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা ব্যক্তিগত মতামত থেকে সেখানে স্বাক্ষর করেছেন কোনো শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব করে নয়।
বুধবার (১৪ আগষ্ট) কয়েকজন শিক্ষার্থী মিলে এই আবেদনপত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে দেন বলে নিশ্চিত করেছেন রেজিস্ট্রার মো. মুজিবুর রহমান মজুমদার। তবে শিক্ষার্থীদের পরিচয় সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু বলতে পারেননি তিনি।
আবেদনপত্রে উল্লেখ করা হয়, 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সফলতার পরেও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. হুমায়ুন কবিরকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে উনার সাথে বৈষম্য সৃষ্টি করা হচ্ছে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন চলাকালীন তিনি শিক্ষার্থীদের খোঁজ খবর নিয়েছেন পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন। উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈনের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপরে হামলা করা হলেও তিনি সে হামলায় আহত শিক্ষার্থীদের দেখতে গিয়েছেন, খোঁজ খবর নিয়েছেন। তাই উপাচার্যকে পদত্যাগ করতে হবে এবং উপ-উপাচার্যকে পদত্যাগ করতে যেনো বাধ্য না করা হয়। পাশাপাশি উপাচার্যের পদত্যাগ নিশ্চিত করে আগামী ১৮ তারিখ থেকে স্বশরীরে যেনো ক্লাস শুরু করা হয় সে আল্টিমেটাম দেওয়া হয়।"
তবে উক্ত আবেদনপত্র 'সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষ' থেকে বলা হলেও সাক্ষরকারীরা তাদের ব্যাচের প্রতিনিধিত্ব করে নয় বরং নিজস্ব মতামতের ভিত্তিতে স্বাক্ষর করেছেন বলে জানান। এই স্বাক্ষরকারীরা হলেন, গনিত বিভাগের ১২ তম ব্যাচের হান্নান রহিম, নৃবিজ্ঞান বিভাগের ১৩তম আবর্তনের আল আমিন ও রায়হান মিয়া, ফার্মেসি ১৫ ব্যাচের শিক্ষার্থী আব্দুর রহমান, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ১৪ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী হাসান ইমাম, অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ১৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী নাঈম, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগের ১৫ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী রিফাত। উল্লিখিত ব্যাচের শিক্ষার্থী ও প্রতিনিধিরাও জানান তারা এ ব্যাপারে কিছুই জানতেন না।
এছাড়া স্বাক্ষরকারীদের মাঝে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ১৫ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী রমজান আলী জানান তিনি জানেনই না তার স্বাক্ষর এখানে গিয়েছে, তার থেকে কোনো প্রকার অনুমতি নেয়া হয়নি এবং তাকে এই বিষয় কিছু জানানো হয় নি।
আবার পরিসংখ্যান ১৫তম বিভাগের হয়ে স্বাক্ষর করেছেন হাসানুল আলম নামে এক শিক্ষার্থী। তবে সে ব্যাচের প্রতিনিধি খান মুহাম্মাদ সালেহ্ নিশ্চিত করেছেন যে তাদের ব্যাচে এই নামে কোনো শিক্ষার্থীই নেই।
সাক্ষরের বিষয় জানতে চাইলে গণিত বিভাগের ১২ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী হান্নান রহিম বলেন, ‘আমি কারো প্রতিনিধিত্ব করে নয়, নিজের মতামতের ভিত্তিতে সাক্ষর করেছি।’
ইকোনমিকস বিভাগের ১৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী নাঈম বলেন, 'আমি কারো প্রতিনিধি হিসেবে নয় নিজের মতের অনুযায়ী সাক্ষর করেছি৷ আমার মনে হয়েছে এই মূহুর্তে উনার পদত্যাগের প্রয়োজন নেই, তাই সাক্ষর করেছি।'
নৃবিজ্ঞান বিভাগের ১৩ তম ব্যাচ থেকে স্বাক্ষর করা শিক্ষার্থী রায়হান জানায়, 'আমি আমার ব্যাক্তিগত জায়গা থেকে দিয়েছি, ব্যাচ বা ডিপার্টমেন্টের প্রতিনিধিত্ব করে না।'
স্বাক্ষরকারী আরেকজন মার্কেটিং বিভাগের ১৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মোরশেদ জানান, 'আমার কাছে একজন সমন্বয়ক পরিচয়ে বলেছে সিগনেচার করতে তাই আমি করেছি। কিন্তু ব্যাচ বা অন্য কোন শিক্ষার্থীর সাথে সে আলোচনা করে আমি করিনি। আমি এটা ব্যক্তিগত মতামত থেকে করেছি।'
জাল সইয়ের বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ১৫ তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায় যে, 'আবেদন পত্র উল্লেখিত 'রমজান আলী - MCJ 15' নামক যে স্বাক্ষর আছে সেটি তাদের সহপাঠী রমজান আলির নয়। এই স্বাক্ষরের সাথে সেই ব্যাচের শিক্ষার্থীদের কোন প্রকার সম্পৃক্ততা নেই। তারা সেখানে স্বাক্ষর জালিয়াতি করা একটি ফৌজদারি অপরাধ উল্লেখ করে এই কাজের সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের আহবান জানান।'
এই বিষয় উক্ত ব্যাচের প্রতিনিধি মারুফ শেখ বলেন, 'আমরা এই দাবীর সম্পর্কে কিছুই জানিনা। তারই সাথে কারা আসলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারের পেছনে লুকিয়ে এই জালিয়াতি করেছে সে বিষয়ে আমরা অবগত নই। তবে আমাদের ব্যাচের শিক্ষার্থীদের সাথে যে প্রতারণা করা হয়েছে, তা একটি অপরাধ এবং সাক্ষর জালিয়াতি ১৮৬০ ধারা মোতাবেক ফৌজদারি অপরাধের মধ্যে পরে। তাই যে বা যারা অপরাধী তাদের বিরুদ্ধে আমরা অভিযোগ দিবো এবং সিসিটিভি ক্যামেরা থেকে আবেদনপত্র জমা দেওয়া অজ্ঞাতনামা এই মানুষদের খুঁজে বের করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রশাসনের নিকট জোর দাবি জানাবো।'
পরিসংখ্যান ১৫ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী হয়ে স্বাক্ষর করা হাসানুল আলম নামে কোনো শিক্ষার্থীই সেই ব্যাচে নেই বলে নিশ্চিত করেছেন ব্যাচের প্রতিনিধি খান মুহাম্মাদ সালেহ্।
এ বিষয় তিনি বলেন, ‘আমাদের ব্যাচে "হাসানুল আলম" নামের কেউ নেই। পাশাপাশি এই আবেদনের ব্যাপারে আমি কিংবা আমার ব্যাচের কেউই অবগত ছিলাম না। বানোয়াট একটা নাম দিয়ে আমাদের ব্যাচ কে ইউজ করা হয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে নিজেরা স্বাক্ষর দিয়েছে। পরিসংখ্যান ১৫ তম ব্যাচের পক্ষ থেকে আমরা এই ফ্রড কাজের নিন্দা জানাচ্ছি ও তাদের এই স্টেটমেন্ট প্রত্যাখ্যান করছি। পাশাপাশি আমরা তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিবো।’
সাধারণ শিক্ষার্থীদের নাম করে ২৬ জনের স্বাক্ষরিত 'উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. হুমায়ুন কবিরের পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে নতুন বৈষম্য সৃষ্টির প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ' শিরোনামে 'সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষ' থেকে যে আবেদনপত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবর দেয়া হয়েছে সেটার প্রতিও ক্ষোভ জানিয়েছে শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন আন্দোলনের সময় আমরা যখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলাম তখন উপ-উপাচার্য এই আন্দোলনের সময় আমাদেরকে হল থেকে বের করে দিতে এসেছিলেন।
এই বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের (যেটির নাম শিক্ষার্থীরা পাল্টে ‘বিজয়-২৪ হল’ দিয়েছে) আবাসিক-
শিক্ষার্থী মিরহাম রেজা বলেন, ‘উপ-উপাচার্য স্যার ১৮ তারিখ আন্দোলনের পর রাতে হলে এসে আমাদের ডিরেক্ট বলেছিলেন হল ছেড়ে দিতে হবে। আমরা স্যারকে জিজ্ঞেস করছি হল ছেড়ে দিবো কেন? উনি আমাদের উত্তরে বলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে কোনো কিছু নেই তারা নিরাপত্তা দিতে অসংগতি জানাই। এছাড়া তিনি বলেছিলেন এটা জাতীয় বিষয়। আমরা যখন হল ছাড়তে চাচ্ছিলাম না তখন তিনি বলেছিলন তোমরা হলে থাকা অবস্থায় কোনো অঘটন ঘটলে তার দায়ভার আমরা নিবো না। আমাদেরকে নিরাপত্তাহীনতার ভয় দেখিয়ে পরের দিন সকাল ১০টার মধ্যে হল ছাড়তে বলেন। এছাড়া তিনি আমাদের নিরাপত্তার কথা না বলে নোবিপ্রবির হল বন্ধের উদাহারণ দেখিয়েছেন। এরকম মেরুদন্ডহীন প্রশাসন আমরা চাই না।’
একই বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের (যেটির নাম শিক্ষার্থীরা পাল্টে ‘বিজয়-২৪ হল’ দিয়েছে) আবাসিক-
শিক্ষার্থী রকিবুল হাসান সোহাগ বলেন, 'উপ-উপাচার্য স্যার ১৮ তারিখ আন্দোলনের পর রাতে হলে এসে আমাদের বলেছিলেন হল ছেড়ে দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের হাতে এখন কিছু নেই এটা জাতীয় বিষয়, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে হল খালি হয়েছে উদাহরণ টেনে উনি নোবিপ্রবির কথা বলেন। রাত ১টায় এসে হল ছেড়ে দিতে বলা কোন ধরনের সহযোগিতা? উনি কোনো সহযোগিতাই আমাদের আন্দোলনের সময় করে নি।'
উল্লেখ্য, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হুমায়ূন কবির আওয়ামী সরকারের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নীল দল (আওয়ামীপন্থী) থেকে নির্বাচন করে সিন্ডিকেট মেম্বার নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়া গত ১৩ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আন্দোলনকারীরা উপ-উপাচার্যের রুমে তালা দেন। এর আগে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ব্যানারেই উপ-উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করেন শিক্ষার্থীরা।
মন্তব্য করার জন্য লগইন করুন!