রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই অমর পঙক্তি— 'প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস/ তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ', যেন চৈত্রের এই সর্বনাশী রূপেরই প্রতিচিত্র। কিন্তু কেন চৈত্র মাস এত সর্বনাশা? কেনই বা ‘চৈতা পাগল’ বলে একটি বিশেষ শব্দবন্ধের প্রচলন হয়েছে বাংলায়?
প্রেমের বসন্ত, বিরহের চৈত্র
ফাল্গুন মানেই বসন্তের মাতাল হাওয়া, কোকিলের ডাক, নতুন পাতার কোমল স্পর্শ, আর প্রেমের আবেশ। কিন্তু এক মাসের ব্যবধানেই সবকিছু যেন বদলে যায়। রঙিন বসন্তের রেশ কাটতে না কাটতেই চৈত্র আসে রুক্ষতা আর বিরহ নিয়ে। প্রেমের উন্মাদনা মিলিয়ে গিয়ে হৃদয়ে জমে ওঠে এক শূন্যতা।
কবিগুরুর কবিতায় চৈত্রের আবহ পাওয়া যায় বারবার। 'বিরহ' কবিতায় তিনি চৈত্রের প্রাকৃতিক দৃশ্যের মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন বিচ্ছেদের যন্ত্রণা— খেতের গন্ধ, খরতর রোদ, শুকনো পথ, দগ্ধ মাঠ, ক্লান্ত গ্রাম— সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে এক বিচ্ছেদের করুণ আবহ।
‘চৈতা পাগল’ এবং সর্বনাশের গল্প
বাঙালি সমাজে প্রচলিত আছে ‘চৈতা পাগল’ কথাটি। শোনা যায়, কেউ কেউ সারা বছর ভালো থাকলেও চৈত্র মাস এলেই আচমকা উন্মাদ হয়ে ওঠেন! যেন প্রকৃতির দাবদাহের সঙ্গে তাদের মনও জ্বলে ওঠে। হয়তো বিরহ, নাহয় স্মৃতির অতল গহ্বরে ডুবে যাওয়ার ফলই হলো এই ‘চৈতা পাগল’-এর জন্ম।
রাধা-কৃষ্ণ থেকে বঙ্কিমচন্দ্রের কাহিনি
বসন্ত আর চৈত্রের এই দ্বৈরথ নতুন কিছু নয়। কৃষ্ণ যখন বৃন্দাবন ছেড়ে চলে যান, তখন রাধার বুকে জন্ম নেয় এক অব্যক্ত যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণাই ধরা পড়ে তাঁর কণ্ঠে—
'আইল চৈত্র মাস।/ কী মোর বসতী আশ।/ নিফল যৌবনভারে।/ বিরহে আন্তর জ্বলে।’
এভাবেই ফাল্গুনের প্রেম চৈত্রে এসে পরিণত হয় বিরহে। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর থেকে শুরু করে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়— সকলেই দেখিয়েছেন বসন্তের প্রেম আর চৈত্রের বিরহের অনিবার্য সংঘাত। কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের শেষ অধ্যায়ে চৈত্রের বাতাসের প্রবলতায় নবকুমার ও কপালকুণ্ডলার করুণ পরিণতিই যেন এই বিরহের এক চূড়ান্ত রূপ।
চৈত্রসংক্রান্তি: সর্বনাশের পর নতুন শুরুর বার্তা
চৈত্রের বিচ্ছেদ আর হাহাকার যেন ধুয়ে-মুছে নতুন করে শুরু করার আহ্বান নিয়ে আসে সংক্রান্তি। একসময় গ্রামে-শহরে ঘুরে বেড়াত সঙের দল, নেচে-গেয়ে পরিবেশন করত বারো রকমের হাস্যরসাত্মক খবর। ১৯১৬ সালের এক সংবিষয়ক পুস্তিকায় লেখা ছিল, ‘সংটা আর কিছু নয়, খালি দুনিয়া শিক্ষা দিতে।’
বৈশাখ আসার আগে চৈত্রের এই সংক্রান্তি যেন জানান দেয়— সবকিছু শেষ নয়, নতুন সূর্যের আলোয় শুরু হবে নতুন গল্প।
চৈত্রের দাবদাহ যেমন প্রকৃতিকে পোড়ায়, তেমনি মানুষের হৃদয়েও জাগিয়ে তোলে বিচ্ছেদ, শূন্যতা আর এক গভীর অনুভূতি। তবু প্রকৃতির এই নিয়ম মেনে নিতে হয়। প্রেম যদি সত্য হয়, তবে বিরহও সত্য। বসন্ত যদি রঙিন হয়, তবে চৈত্রের রুক্ষতা তারই অনিবার্য পরিণতি। অতএব, চৈত্রের দায় রবীন্দ্রনাথের কাঁধে চাপিয়ে লাভ নেই— প্রকৃতি নিজেই এর স্রষ্টা।
মন্তব্য করার জন্য লগইন করুন!