কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার ধলা ইউনিয়নের সেকান্দরনগর বাজারে নতুন নৌকা তৈরি, পুরাতন নৌকা মেরামতের কাজ করছে স্থানীয় কারিগররা। স্থানীয়ভাবে এগুলোকে কোষা নৌকা হিসেবেই জানেন সবাই।
বর্ষা মৌসুমে চারদিক যখন পানিতে থৈ থৈ করে তখন কিশোরগঞ্জ জেলার হাওড় অঞ্চলের মানুষের চলাচলের একমাত্র বাহন নৌকা। তাড়াইল উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষসহ আশপাশ উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ বর্ষায় চলাচলের জন্য কারিগররা তৈরি করছেন বিভিন্ন সাইজের কোষা নৌকা। বর্ষাকে মোকাবেলা ও প্রস্তুতি নিতে এসব অঞ্চলে ছোট-বড় নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কারিগররা। নতুন নৌকা তৈরির পাশাপাশি পুরাতন নৌকা গুলোও মেরামতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন এ অঞ্চলের মানুষ।
এ মৌসুমে নৌকা কারিগরদের ব্যস্ততার শেষ নেই। তবে সারা বছর নৌকা তৈরির কাজ না থাকায় বর্ষা মৌসুমের অপেক্ষায় থাকেন নৌকা তৈরির কারিগররা।
বুধবার (০৩ জুলাই) তাড়াইল উপজেলার সেকান্দরনগর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, কারিগররা ছোট-বড় নানান রকম নৌকা বানাচ্ছে। কেউ কাঠ কাটছে, কেউ মাপজোক আবার কেউবা হাতুড়ি দিয়ে তারকাটা লাগাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কাজের ফাঁকে কথা হয় সেকান্দরনগর গ্রামের বাসিন্দা নৌকা তৈরির কারিগর শাহরিয়ার সাথে। তিনি বলেন, কয়েক বছর ধরে নৌকা তৈরির কাজ করছি। বড় নৌকার চেয়ে ছোট নৌকার চাহিদা অনেক বেশী। একটি ১৪ হাতের ডিঙ্গি নৌকা তৈরি করতে দুইজন মিস্ত্র্রির ৪ থেকে ৫ ঘন্টা সময় লাগে। এ নৌকাটি বিক্রি করা যায় ৪ থেকে পাঁচ হাজার টাকা। তবে শিমুল, কাঁঠাল, চাম্বল, রঙিন, আম, গাব ও কদমসহ বিভিন্ন কাঠ দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে এসব নৌকা। কাঠের ধরনের সাথে নৌকার দামের তারতম্য হয়। তবে সবচেয়ে ভালো মানের নৌকা তৈরি হয় রঙিন কাঠ দিয়ে। দামও একটু বেশি। রঙিন কাঠের ১১ হাত একটি কোষা নৌকা ৮ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। টেকেও বেশিদিন। রঙিন কাঠের একটি নৌকা একাধারে পাঁচ বছর ব্যাবহার করা যায়। অন্যান্য কাঠ দিয়ে তৈরি নৌকা দুই থেকে তিন বছর ব্যাবহারের উপযোগী থাকে।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাড়াইল উপজেলার শুধুমাত্র সেকান্দরনগর বাজারেই তৈরি হয় এসব নৌকা। বর্ষা মৌসুমে হাওড় এলাকার মানুষের হাতে কোনও কাজ না থাকায় এসব নৌকা নিয়ে মাছ শিকার, পশু খাদ্য ও একপাড়া থেকে অন্যপাড়াতে যাতায়াতে ব্যাবহৃত হয়। তবে রাতে টর্চের আলোতে মাছ শিকার করার জন্য প্রধান বাহন হিসেবে ব্যাবহৃত হয়।
সেকান্দরনগর বাজারের কাঠের ব্যাপারী সোহানুর রহমান বলেন, সারাবছর ঘরের আসবাবপত্র তৈরির কাজ করি। কিন্তু বর্ষা কালে নৌকা তৈরির কাজ করি, এসময় নৌকার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় অনেকে নৌকা তৈরি করতে আসে। বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে বর্ষার সময় কাঠ মিস্ত্রিদের কাজের চাপ বেশী থাকে। আয় রোজগারও বেশী হয়।
বর্ষাকাল ছাড়া নৌকা তৈরির কাঠ কিনতে কেউ আসে না। অন্য সময় গুলোতে ব্যাবসা মন্দা হয়ে পড়ে। কারিগররাও কষ্টে দিন পার করে। আমরা ব্যাবসায়ী ও কারিগররা বর্ষা মৌসুমের অপেক্ষায় থাকি। বর্ষাকালে নিচু অঞ্চলের মানুষ নৌকা বেশী ব্যাবহার করে। নৌকা তৈরি করে দোকানে রেখে দুর দুরান্তের বিভিন্ন স্থানের ক্রেতার কাছে নৌকা বিক্রি করছি। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেকান্দরনগর বাজারের নৌকা আশপাশের উপজেলাসহ বিভিন্ন জেলার লোকজন এখানে এসে নৌকা কিনে নেন। ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ, কানুরামপুর, নান্দাইল এবং নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া, মদন উপজেলা থেকে প্রতিদিনই লোকজন এসে নৌকা কিনে নেন। তাছাড়া পার্শবর্তী ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও করিমগঞ্জ উপজেলার লোকজনও এখান থেকে এসব কোষা নৌকা কিনে নেন। নৌকা তৈরির অন্যান্য কারিগরদের সাথে কথা হলে তারা বলেন, আগে প্রতিদিন এই বাজারের প্রায় ২০টি দোকানে মোট ২শ নৌকা বিক্রি হতো। এবছর বৃষ্টি কম থাকায় নদীনালায় পানি দেরীতে আসায় নৌকা বিক্রি খুব কম হচ্ছে। এখন প্রতিদিন ৫ থেকে ৭ টি নৌকা বিক্রি হয়। এজন্য আমাদের অলস সময় পার করতে হচ্ছে। প্রতিটি নৌকা তৈরি করে ৮শ টাকা মুজুরি পাই। একটা নৌকা তৈরিতে কমপক্ষে দুইজন কারিগর দরকার। ভালো বিক্রি হলে গভীর রাত পর্যন্ত প্রতিদিন ৫ থেকে ৬টা নৌকা তৈরি করা যায়।
উপজেলার কালনা গ্রামের মুজিবুর রহমান জানান, নিচু এলাকার সড়ক গুলো পানিতে ডুবে গেলে চলাচলের একমাত্র উপায় এসব কোষা নৌকা। বর্ষাকালে প্রতি মুহুর্তে নৌকার প্রয়োজন হয়। হাটে বাজারে, ছেলে মেয়েদের স্কুল কলেজে, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম বা অন্য পাড়ায় যেতে এসব নৌকা খুব দরকারী।
মন্তব্য করার জন্য লগইন করুন!