সামাজিক জীবন বিচিত্রার অফুরন্ত সফলতা সভ্যতার উন্মেষ সাধন এবং বাংলা শিল্প সাহিত্যে বর্ণাঢ্য আঙ্গিকে কবিগুরুর আবির্ভাব ছিল অনন্য নতুন ধারা। জীবন সুন্দর, সাহিত্য কর্মের নানা বৈচিত্রে, চিত্র রূপময়তা, ঐতিহ্য প্রীতি, বাস্তব চেতনা ও শুদ্ধ জ্ঞান সম্বলিত একজন উৎসুক অকৃত্রিম স্বপ্নদ্রষ্টা। কবির জন্ম কলকাতার এক ধন্নাঢ্য ও সাংস্কৃতিবান ব্রাহ্ম পরিবারে। ১৮৬১ সালের ৭ই মে এবং ১২৬৮ বঙ্গাব্দ ২৫ শে বৈশাখ বাংলার আকাশে একটি নতুন উজ্জ্বল তারার জন্ম হলো।
পিতা ছিলেন মহীর্ষি দেমন্দ্রনাথ এবং মাতা সারদা দেবী। তিনি ছিলেন পিতা-মাতার চতুর্থ দশ সন্তান। রবীন্দ্রনাথের পিতৃ পুরুষের আবাসভূমি ছিল বাংলাদেশের খুলনা জেলার রূপসা উপজেলার অন্তর্গত ঘাট ভোগ ইউনিয়নের পিঠাভোগ গ্রামে। ৬ বছর বয়সে ওরিয়েন্টাল সেমিনারি তে ভর্তি হলেও গৃহ শিক্ষক দ্বারা বাড়িতে তার শিক্ষার কার্যক্রম চলতো রবি ঠাকুরের পারিবারিক বাসভবন ছিল কলকাতার জোড়াসাঁকোর ৬ নং ধারাকনাথ ঠাকুর লেনে। যেখানে তার জন্ম হয়। তার পিতা দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন রামমোহন রায়ের বন্ধু এবং ব্রাহ্ম ধর্মের প্রধান সংগঠক। রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর তিনি ব্রাহ্ম ধর্মের প্রধান কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেন এবং মহীর্ষি উপাধিতে ভূষিত হন। ছোটবেলায় কবিগুরু জোড়াসকোর বাড়িতে এবং বোলপুর ও পানিহাটির বাগানবাড়িতে প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘুরে বেড়াতে বেশি পছন্দ ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। এভাবে বাংলার রূপ বন-ছায়া তাকে দারুন ভাবে আকৃষ্ট করে। এক সময় হয়ে ওঠেন প্রকৃতি পূজারী আকাশ ভরা তারার মেলায় মুক্ত হাওয়ায়, সাহিত্য চর্চায় মন-প্রাণ উজাড় করে কাব্যচর্চায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। শিশু কাল থেকে তিনি কবিতার চর্চা করতেন।
১৮৭৩ সালে ১১ বছর বয়সেই পিতার সাথে কয়েক মাসের জন্য দেশ ভ্রমণে বের হন। প্রথমে অবস্থান নেন পারিবারিক স্টেট শান্তিনিকেতনে।এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সুন্দর নিবিড় সান্নিধ্য তাকে অভিভূত করে। মাত্র ৮ বছর বয়সেই রবীন্দ্রনাথ কবিতা রচনা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে তার "অভিলাষ" কবিতাটি 'তত্ত্ববোধিনী' পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৮৭৫ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে মাকে হারান। পিতার তেমন সান্নিধ্য পাননি, ফলে ধন্নাঢ্য পরিবারের সদস্য হওয়া সত্বেও তাকে থাকতে হয়েছে নকর ভৃত্যদের তত্ত্বাবধানে।
১৮৭৮ সালের অক্টোবরে ১৭ বছর বয়সে ব্যারিস্টারী পড়ার উদ্দেশ্যে প্রথমবার ইংল্যান্ডে আসেন মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে এবং লন্ডনের ঠাকুর পরিবার একটি বাড়িতে অবস্থান নেন। লন্ডনের একটি স্কুলে এবং পরে লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজে আইনবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু তার মনে দেশের সংগীত বিষয়ে অসীম কৌতুহল ছিল কিন্তু সাহিত্য চর্চায় প্রবল আগ্রহ ও আকর্ষণের ফলে সেই পড়াশুনা তিনি সমাপ্ত করতে পারেননি। এই সময় শেক্সপিয়ার সহ অন্যান্য ইংরেজ সাহিত্যিকদের রচনার সাথে তার ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটে।
অবশেষে ১৮৮০ সালে কোন ডিগ্রী না নিয়ে রবীন্দ্রনাথ দেশে ফিরে আসেন। এবং প্রবাস জীবনের আলোকে এবং অভিজ্ঞতার আদলে ১৮৮১ সালে গীতিনাট্য বাল্মিকীর প্রতিভা রচনা করেন এতে তিনি স্বরচিত গানের সাথে পাশ্চাত্য সুরের মিশ্রণ ঘটান। এক সময় ঠাকুর বাড়ির "বিদ্বজ্জন সমাগম" উপলক্ষে বাল্মিকী প্রতিভার মন্তঃস্থ হয়। রবি ঠাকুর এতে বাল্মিকীর চরিত্রে অভিনয় করেন। তার ভাতুষপুত্রী প্রতিভা অভিনয় করেন সরস্বতীর ভূমিকায়। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের প্রথম অভিনয় ছিল এমন কর্ম করবো না নাটকে অলীক বাবুর ভূমিকায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর দার্শনিক ও কবি, মেজ ভ্রাতা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন প্রথম ভারতীয় আই সি এস, অন্য ভ্রাতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ ও নাট্যকার, এবং বোনদের মধ্যে স্বর্ণকুমারী দেবী উপন্যাসীক হিসেবে খ্যাতি ছিল। তাই ঠাকুর বাড়ির পরিবেশ শিল্প, সাহিত্য ও নাট্যভিনয়ে মুখর অপরূপ ভরপুর প্রাণোচ্ছল । শুধু ঘরের মধ্যেই নয় বাইরের জগতের সাথে ছিল নিবিড় যোগাযোগ ও বন্ধন। এরই মধ্যে তার জীবনের সফলতা, মানবিক ও আত্মিক উৎকর্ষ সাধনের ব্যাপৃতি ঘটে, বিশেষ করে সাহিত্য প্রতিভার ব্যাপক উন্মেষ ঘটে। প্রকাশিত হয় তার লেখা বিভিন্ন পত্রিকায়।
রবীন্দ্রনাথের জৈষ্ঠ ভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পাদনায় ১৮৭৭ সালে মাসিক ভারতী প্রকাশিত হয়। তারও কিছু আগে দাদার আন্তরিক অনুপ্রেরণায় "বনফুল" নামক একটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। এরপর "কবি কাহিনী"; "সন্ধ্যা সঙ্গীত," "প্রভাত সঙ্গীত", "ছবি ও গান", "কড়ি" ও "কোমল" প্রভৃতি কাব্য একের পর এক প্রকাশিত হয়।
১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর ঠাকুর বাড়ির কর্মচারী বাংলাদেশের খুলনার বেণীমাধব রায়চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণীর সঙ্গে রবি ঠাকুর বিবাহ সূত্র আবদ্ধ হন। পরে তার নাম পরিবর্তন করে মৃণালিনী দেবী রাখা হয়। তাদের ৫ সন্তান ছিলো, তাদের মধ্যে দুই পুত্র তিন কন্যা। মাধবীলতা, রথীন্দ্রনাথ, রেনুকা, মিরা ও সমীন্দ্রনাথ।
১৮৮২ সালে কলকাতার ১০ নং স্ট্রিটে অবস্থানকালে রবি ঠাকুর" নিঝড়ের স্বপ্ন ভগ্ন" কবিতাটি রচনা করেন। এটি ছিল তার সমগ্র সৃষ্টিকর্মের ইঙ্গিতবাহী কবিতা। কলকাতার বাইরে এসে পল্লীর মোহনীয় সৌন্দর্য, তৃণমূল মানুষের নিবিড় সান্নিধ্য, তাদের চালচলন, অভিজ্ঞতা, বাচনভঙ্গি, প্রকৃতির ছায়া তলে সাফল্যের ধারাবাহিকতা ও স্বতন্ত্র প্রতিফলন ফুটে ওঠে নিবিড় ভাবে তার কাব্য লিখেনিতে। এবং রচনা করেন "মানসী," "সোনার তরী","চিত্রা" প্রভৃতি বিখ্যাত কাব্য গ্রন্থগুলো।
১৮৯০ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি সত্যেন্দ্রনাথের সাথে দ্বিতীয়বার এক মাসের জন্য ইংল্যান্ডে যান। অক্টোবরে ফিরে আসার পর পিতার আদেশে জমিদারি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারই আলোকে উদ্ভাসিত হয় সাহিত্যকর্মের বিচিত্র ও নানা ধ্যান-ধারণা ও পথ। আগের ভাবমুলক ও বিশুদ্ধ কল্পনার ঊর্ধ্বে নতুন জাগতিক ধ্যান-ধারণা, লোক জীবনের কাছাকাছি অবস্থান এবং ধনী দরিদ্রসহ সাধারণ মানুষের প্রত্যক্ষ জীবন পর্যবেক্ষণ। প্রকৃতির অপরূপ রূপ যা তার লিখনি ও গল্পগুলো সমৃদ্ধ করেছে।
পিতার আদেশক্রমে ১৮৯১ সালে তিনি বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়া, রাজশাহী, পাবনা ও উড়িষ্যার ঠাকুর পরিবারের জমিদারি তদারকির জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তারই লক্ষ্যে কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুটির বাড়িতে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেন। "পদ্মা" নামে বিলাসবহুল পারিবারিক বজরায় চড়ে প্রজা বর্গের কাছে খাজনা আদায়, কুশল বিনিময় এবং গ্রামবাসী তার সম্মানে ভোজ সভার আয়োজন করলে তাতে অংশগ্রহণ করতেন। তিনি গ্রামবাসীর সাথে মিশতেন বন্ধুর মত। বাংলার রূপ, গুন, আথিয়তা, বাংলার অপার সৌন্দর্যে তার লেখনি শক্তি আরো ব্যাপক হয় ওঠে। এভাবে শিলাইদহে গড়ে ওঠে একটি কবি তীর্থ। এবং পদ্মা নদীর বুকে নৌকা ভবনের সময় পার্শ্ববর্তী গ্রাম বাংলার সরল মানুষের সান্নিধ্য, কবির সাথে সাহিত্যের একটা বিশেষ অবস্থান গড়ে ওঠে।
১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ থেকে শান্তিনিকেতনে স্থানান্তরিত হন এবং একই বছর ডিসেম্বরে মহর্ষির অনুমতি নিয়ে তিনি শান্তিনিকেতনে একটি স্কুল স্থাপন করেন। সেই সময়ের নাম ছিল "ব্রহ্ম চর্যাশ্রম", পরবর্তীকালে "শান্তি নিকেতন"। বিদ্যালয় এটি মাত্র পাঁচজন ছাত্র নিয়ে শুরু হয় এবং রবি ঠাকুরের পুত্র রথীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রথম ছাত্র। কবির স্ত্রী মৃণালিনী দেবী ছাত্রদের দেখাশোনা করতেন। কবিগুরুর জীবনমুখী আদর্শ শিক্ষা ব্যবস্থার বিরাজমান কল্পনা বাস্তবে রূপ লাভ করল এবং এটি বিশ্বভারতীয়তে পরিণত হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে। বিশ্ব মৈত্রীর সংকল্প এবং নতুন আস্থা নিয়ে।
১৯০২ সালে কবি পত্নী মৃণালিনী দেবীর মৃত্যু হয় এবং কয়েক মাসের মধ্যে কন্যা রেনুকা মারা যান। ১৯০৫ সালে পিতা দেবেন্দ্রনাথ ইহলোক ত্যাগ করেন।
পিতার মৃত্যুর পর তার কর্মের দায়িত্ব কবির উপর এসে পড়ে। তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত হন মহর্ষির আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক হিসাবে। যদিও সে সময় ব্রাহ্মসমাজ নানা রকম দ্বিধা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিল। তথাপি তিনি নিষ্ঠার সাথে তার অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন।
১৯০৭ সালে মারা যান কবির কনিষ্ঠপুত্র। এতদো সত্বেও কবি শান্ত চিত্তে আশ্রমের দায়িত্ব চালিয়ে যান। এবং তার সাহিত্য জীবনের চর্চা শান্তিনিকেতনে বিশেষ উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম ছিলেন। এখানেই রচিত হয়েছিল "চোখের বালি," "নৌকাডুবি" এবং "গোরা" উপন্যাস। যাতে ফুটে উঠেছে জীবনের বাস্তবতা, মনস্তত্ত্ব এবং স্বদেশের নানা উত্থান পতন। এখানেই রচিত হয় বিখ্যাত কবিতা "ভারত তীর্থ' এর মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠে ভারতবর্ষের জাতীয় প্রকৃতি এবং তাৎপর্যময় অর্থবহ ইতিহাস।
কাব্য সাহিত্যের বৈশিষ্ট্যে প্রকৃতি, প্রেম ভরা, গীতিময়, মানব ভালোবাসা, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকে নানা বাস্তবতায় গভীর মিলন। মানব প্রেম, আবেগ, সত্য সুন্দরের সন্ধান কবিতায় ও চিত্রকলা শব্দের শিখর সন্ধানী আপন গৌরবোজ্জ্বল মহিমায়। কবিতায় আবহমান কাল ধরে চলমান বিশলতায় আনেন নতুন আপ্লুত সজীবতা। ছন্দে, বর্ণে ও গন্ধে সৃজনশীল পূর্ণতা মহাকালের সৃষ্টিশীল কাব্য ভান্ডারে। বহু বর্ণময় কাব্য রচনা দার্শনিক গাম্ভীরে উৎফুল্লতায় ভরা উৎসবে উদ্ভাসিত। সকল ধর্মীয় ও সামাজিক গোঁড়ামির বিরুদ্ধে ছিলেন সর্বদাই সোচ্চার এবং শক্ত অবস্থান। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তিনি সর্বাঙ্গে সর্বদায় ছিলেন সত্যবাদী, যা তিনি ধারন করে রাখতেন অন্তরের অন্তঃস্থলে। তিনি মানব জীবনের বর্ণময় বরেণ্য চিরসবুজের কবি। সামাজিক অভিজ্ঞতার নানা মননশীল উষ্ণতা ছিল তার চিন্তার ছোঁয়ায় এবং যা তার লেখনীতে তথা কাব্যে, গল্পে, ও গানে ফুটে উঠত নির্মল আলিঙ্গনে সীমাহীন গভীরতায়। পাখিদের বিচিত্র নানা বর্ণের পালকের মতো অপরূপ ছন্দে ভরপুর কাব্যের লিখন। মন হারিয়ে যায় দূর আকাশের নীলিমায়। প্রকৃতির নানা রূপময় সৌন্দর্যের অফুরন্ত উচ্ছ্বাস ফুটে তার কাব্যে। ভাববাদী এবং সেইসাথে প্রকৃতবাদী মানব দরদী কবি জীবন পূর্ণিমাতে উজ্জল সাহিত্যে, উপন্যাসে এবং কবিতায়। কেবল জ্ঞানের সীমাবদ্ধ না থেকে বোধের শিক্ষায় মানুষের অতি কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার প্রবণতা। সামাজিক গুণের ভাব গাম্ভীর্যতা হৃদয় জুড়ে বর্ণে গন্ধে হাসনেহেনার মতো মাতাল করা জীবন ভুবনে। জীবন দর্শনে জীবনের অগ্রগতি প্রকৃতির অনুরাগের ডালিতে শত ফুলের মতো অপরূপ। ভরপুর চেতনার রং আলোময় নিদারুণ সৃষ্টি। পূর্ণিমার আলোর সাগরে ভেসে বেড়ায় হৃদয় জুড়ানো নির্মল অনুভূতি।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় অন্ধ গোরামির বিরুদ্ধে সর্বদাই ছিল সোচ্চার কবির কলম এবং সৃজনশীল সংস্কৃতির নিবিড় বন্ধন। বিশ্ব প্রকৃতির রূপের শোভা নির্মল আকাশ, বাতাস ও তারার রাজ্যে লেখনীর বিস্তৃত ক্যানভাস। কবি বন্দনায় দৃঢ়বদ্ধ বিশ্ব সত্তার সাথে। বাংলার অতীত এবং বর্তমান লোকসাহিত্যের ঐতিহ্য ও ঐশ্বর্য মুগ্ধ কবি তার নান্দনিক ভাষায় বলেন "জনপদের হৃদয় কলবর"। মানুষ মানুষের ঐক্য বন্ধন ও সৌভ্রাতের সেতুবন্ধন। রবি ঠাকুরের ভাষায় যা ছিল "রূপসাগরে অরূপ রতন"। তিনি সর্বদা স্বদেশী বঙ্গ-ভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নিজেকে শামিল করেছিলেন। জীবন চলার পথে মানব চিন্তার জীবন দর্শন যা বহে আনতো কবির জীবনে নির্ধারুণ সফলতা। চিত্রশিল্পী ঔপন্যাসিক প্রাবন্ধিক সহ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বিশ্ব বরেণ্য কবি ছিলেন নিঃসন্দেহে কবিদের গুরু। খোলা মাঠে সবুজ গালিচায় গাছের পাতায় অনেক শীতল অনুভূতি তাতেই ছিলেন মুগ্ধ কবি। তারই লক্ষ্যে গড়ে তোলেন ঊনিশ একুশ শতকে শান্তিনিকেতন। যার তিনটি উল্লেখযোগ্য উদ্দেশ্য ছিল।
প্রথমত প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে দ্বিতীয় আদর্শ প্রাকৃতিক ভাবধারায় শিশুদের বেড়ে ওঠা এবং সবশেষে পরিবর্তনশীলতার আবর্তে এই উপমহাদেশের শহর ও গ্রামের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালনা করা। প্রাচীন সাহিত্যের দুরূহতা থেকে সরে এসে কাব্য রচনায় সহজ ও সরল পথ অনুসরণ করেন। কবির সমগ্র জীবনের সাহিত্যকর্মের ডাল-পালা সুউচ্চ বটবৃক্ষের মতো বিশাল শিকড় ছড়িয়ে রেখেছে এই সুজলা সুফলা শ্যামল বাংলার মাটিতে। প্রকৃতির বৃহৎ অঙ্গন কবিকে অভিভূত করে।
আকাশের তারার সাথে মিশে আছে চেতনার উন্মেষ। সাহিত্যকর্মের বিচিত্র পথ চলার আত্মশক্তিতে মনোনিবেশ। সমকালীন সমাজের সমসাময়িক ঘটনা প্রবাহ, অর্পিত দায়িত্ব এবং প্রথাবদ্ধতার বিরুদ্ধে সোচ্চার, এইভাবে কবি বাংলা সাহিত্যে এনেছেন নতুন প্রাণ। অভিনবত্ব কলাকৌশল, নিরন্তর জীবন তত্ত্ব এবং বিশ্ববোধের সেতুবন্ধন। ইতিহাস বিকাশে অর্পিত দায়িত্ব পালনে অবিচল এই মানবী কবি। সরল অনাড়ম্বর জীবনধারা কবির জীবনকে করেছে গভীর অর্থবহ এবং অভিজ্ঞতালব্ধ নতুন দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন মহান ব্যক্তিত্ব। তারই চেতনায় নিগূঢ় পরিবর্তন এবং দার্শনিক নির্লিপ্ততা। কবি আপন করে নিয়েছিলেন এই সমাজ ও ধরিত্রী। তাই একসময় মনের অজান্তে গেয়ে ছিলেন, “ মরিতে চাহিনা আমিই সুন্দর ভুবনে মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই”
কবি যখন অন্তিম শয্যায় চোখের দৃষ্টি আবছা এবং কানে কম শুনছেন। শরীরটা ভেঙ্গে পড়ছে বার্ধক্যের ভারে। চিকিৎসকরা চিন্তিত। সেই সময়ে গোটা জাতি বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধান্ত পরিবেশে আবদ্ধ এবং ভারতবর্ষে ও স্বাধীনতার লড়াই চলছে। এই সন্ধিক্ষণে সর্বজন প্রিয় কবি মৃত্যুর সাথে আলিঙ্গন করতে যাচ্ছেন। তা ভারতবাসী মেনে নিতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। বিধাতার প্রতি এই উপমহাদেশের জনতার আকুল প্রার্থনা আরো কিছুকাল যেন তিনি আমাদের কাছে বেঁচে থাকুন। এবং সেই সাথে করছেন গুরুদেবের আরোগ্য কামনা।
মধুসূদন দত্তের পর বাংলা কবিতা রাজ্যে এক বিশাল ঝুড়ি নিয়ে ছন্দময় কাব্যে রবি ঠাকুরের পদার্পণ। তিনি ছন্দ গুরু তা ছিল সৃষ্টির অপূর্বতা এবং মাহাত্ম্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চোদ্দ ভাই বোনদের মধ্যে ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। ভ্রমণ পিপাসু রবি ঠাকুর পারিবারিক গণ্ডি থেকে বের হয়ে প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসার জন্য সর্বদাই থাকতেন উদগ্রীব। সময় পেলে গঙ্গায় সাঁতার কাটতেন এবং পাহাড়ি সবুজ ঘেরা রাস্তায় হেঁটে llবেড়ানো ছিল খুবই পছন্দনীয়। ডালহৌসির দুই হাজার তিনশ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত বাংলায় বসে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকন করতেন। সেই নয়নাভিরাম ও প্রাণ জুড়ানো বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি কবির মনে আবেগ উপলব্ধি ও কাব্য অনুভূতির জন্ম দেয়। ছবি ছিলেন একজন বৃক্ষ প্রেমী।গানে, কাব্যে ও সাহিত্যে তাই স্থান পেয়েছে অসংখ্য ফুল ও বৃক্ষের নাম।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সভ্যসাচী সাহিত্যিক। সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় যার বিচরণ সৃজনশীল গৌরবে। স্বর্ণকুমারী দেবী সম্পাদিত "বালক" পত্রিকার নিয়মিত লেখক কবিগুরু। তাতে ছিল অসংখ্য গল্প, কবিতা, ছড়া এবং নাটক সহ নানা শিক্ষামূলক শিশুতোষ রচনার সামগ্রী। শিশুদের প্রতি ছিল তার হৃদয়ের ভরা টান। বর্ষার প্রবল বর্ষণে শিশুরা ভালো থাকুক এই কামনায় গিয়েছিলেন, "ওগো, আজ তোরা যাসনে ঘরের বাইরে কি বিশাল অনুভূতি শিশুদের প্রতি।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সাহিত্যকর্ম ও গানের জন্যই বিশ্বখ্যাত শুধু কি তাই, তিনি ছিলেন একজন চিত্রশিল্পী এবং তার ছবি আঁকার ভান্ডার ও বিশাল। তার চিত্রকলার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল তার বর্ণিত স্বকীয় পদ্ধতি। তাকে বেশি আকৃষ্ট করত রেখা ও রঙের সমন্বয়ে যে ছবি আঁকা হয় তার মধ্যে প্রাণও বাণী সঞ্চারনের অন্তর্নিহিত ব্যাপারটি। খেলার ছলেই তিনি শুরু করেছিলেন একসময়। পরবর্তীতে তা নেশায় পরিণত হয়। একটা সময় আবার দক্ষতা ও পূর্ণতা তাকে দারুন ভাবে উৎসাহিত করে তোলে।
রবীন্দ্রনাথের "গীতাঞ্জলি" অনুবাদ হয়েছিল ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেছেন আন্দ্রেজিদ। জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেছেন জার্মান কবি মারি লুইস গোটেইন। কবিতায় রয়েছে সর্বজলীন রূপ। আলো ছড়িয়েছে অন্তর্নিহিত পাঠকের গভীর অন্তরে, ছড়িয়েছে অফুরন্ত প্রেম ও ভক্তি। হৃদয় ছোঁয়া গান, তাইতো কবির ভাষায় "আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে"।
একসময় কবির ঝুলিতে আছে ৯৫ টি ছোট গল্প ৫২ টি কাব্যগ্রন্থ ৩৮টি নাটক ১৩ টি উপন্যাস ও ৩৬ টি প্রবন্ধ। গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান ১৯ টি খন্ডে। ছবি আঁকার প্রবল আগ্রহ ও প্রবণতা ছিল। এঁকেছেন প্রায় দুই হাজারের বেশি ছবি এর মধ্যে শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে শোভা পাচ্ছে কবির ১৫৭৪ টি ছবি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কবিগুরুর মোট ৩১১ টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯১১ সালের ৭ই মে কবিগুরুর ৫০ বছর পূর্ণ হওয়া উপলক্ষে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ দেশবাসীর পক্ষ থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এক উষ্ণ আন্তরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগেই ইউরোপে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। কবিগুরু এই সময় লন্ডনে আসেন ১৯১২ সালের ১৬ই জুন। তার হাতে ছিল তার রচিত নানা কাব্যগ্রন্থের মধ্য থেকে নির্বাচিত কিছু কবিতার ইংরেজি অনুবাদ। এতে তার প্রতিভা এবং সার্থকতা ফুটে ওঠে। যাতে ছিল বাংলার সাহিত্য,,শিল্প, শিক্ষা, প্রজ্ঞা এবং আভিজাতদের স্বীকৃতি। এক সময় ব্রিটিশ বংশভৃত রথেনস্টাইন ভারতবর্ষে এসেছিলেন অবতীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে। সেই সূত্রে রবি ঠাকুরের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। এবং কথা প্রসঙ্গে একদিন কবি তাঁর কবিতার কয়েকটি কবিতার অনুবাদ পাঠ করে শোনালেন। এতে মুগ্ধ রথেনস্টাইন কয়েকটি কবিতা টাইপ করে বন্ধুদের পাঠালেন। এই বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন ইয়েটস ,সটপফোরড -ব্রুকস ও ব্র্যাডলি। সেই প্রেক্ষাপটে কবি যখন লন্ডনে আসেন রথেনস্টাইন তার বাসভবনে এক বড় ধরনের মজলিসের আয়োজন করেন।
এই সময় সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথিগণের মধ্যে ছিলেন মে সিনক্লেয়ার, ইভিলিনআন্ডার হিল, এলিচ মেনেল, হেনরি নেভিলসন প্রমূখ। এবং সেই অধিবেশন নিয়ে কবিগুরুর কবিতা আবৃত্তি করেন বিখ্যাত ইংরেজ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস।
পরবর্তীতে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদে উইলিয়ামস বাটলার ইয়েটস সূচনা লেখেন। কবিগুরুর নিজের অনুবাদ এবং সূচনা সম্বলিত গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হলে ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই উপমহাদেশে তথা এশিয়ায় সাহিত্যে প্রথম নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। একই বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থাকে সম্মান সূচক "ডক্টর অব ল" উপাধিতে ভূষিত করেন। ফলে কবিগুরুর বিচিত্র বহুমুখী প্রতিভা, কাব্য সাহিত্যের গভীর নিপুনতা, অনন্য বৈশিষ্ট্য, কল্যাণ মূলক কর্ম, চিত্ররঙ্গের অনন্যতা্ সপ্ন ভাবনা, প্রকৃতি ও মানব প্রেমের গতিশীল ছন্দ ও আঙ্গিকে বৈচিত্র্যময় প্রকাশ পায়।
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কবি বিজ্ঞানের উপর আসক্তবান হন। এবং ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হয় তার বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ সংকলন "বিশ্বপরিচয়"। শেষ চার বছর তিনি পর্যায়ক্রমে অসুস্থ।
মন্তব্য করার জন্য লগইন করুন!