ক্যাম্পাস প্রতিনিধি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকাঃ বায়জিদ।।
এটি শুধুমাত্র দুটি ব্যক্তির মধ্যে একটি সম্পর্ক নয়, বরং দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনও করে। হিন্দু বিবাহের কিছু মূল বৈশিষ্ট্য এবং বিবাহের প্রকারভেদ নিম্নরূপ:
হিন্দু বিবাহের মূল বৈশিষ্ট্য
পবিত্রতা: হিন্দু বিবাহকে একটি পবিত্র বন্ধন হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যেখানে স্বামী ও স্ত্রী একে অপরের প্রতি দায়বদ্ধ থাকেন।
ঋতুসন্ধি: বিবাহের সময় সাধারণত অগ্নির চারপাশে সাড়া দেওয়া হয়, যা বিবাহের ঐতিহ্য ও ধর্মীয় রীতিকে নির্দেশ করে।
ব্রত ও শপথ: বিবাহের সময় দাম্পত্য জীবন, একে অপরের প্রতি দায়িত্ব এবং ভালোবাসার শপথ নেওয়া হয়।
দোস্তি: বিবাহের মাধ্যমে দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন হয়, যেখানে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন তৈরি হয়।
শাস্ত্রীয় বিধান: হিন্দু বিবাহ শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে পরিচালিত হয়, যা হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন শাস্ত্র ও গ্রন্থ দ্বারা নির্দেশিত।
হিন্দু বিবাহের আট প্রকার
হিন্দু বিবাহের প্রকারভেদকে সাধারণত আটটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়, যা নিম্নরূপ:
ব্রহ্ম বিবাহ (Brahma Marriage):
এটি সবচেয়ে পবিত্র এবং আদর্শ বিবাহ।
একজন পিতার পুত্র বা কন্যার জন্য উপযুক্ত একটি পাত্র বা পাত্রী নির্বাচন করে তাকে গৃহীত করা হয়।
দেব বিবাহ (Deva Marriage):
এটি দেবতার উদ্দেশ্যে একটি কন্যাকে স্বামীর হাতে দান করার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
এটি ধর্মীয় এবং পবিত্র বিবাহ হিসাবে বিবেচিত।
আরিষ্ঠ বিবাহ (Arsha Marriage):
এই বিবাহে, পাত্রীর বাবা পাত্রকে গরুর একটি পণ্য প্রদান করে।
এটি বর-বউয়ের মধ্যে মৈত্রীর সম্পর্ক সৃষ্টি করে।
গন্ধর্ব বিবাহ (Gandharva Marriage):
এটি প্রেমের ভিত্তিতে সংঘটিত হয়, যেখানে পাত্র-পাত্রীর সম্মতি নিয়ে বিবাহ হয়।
এটি সাধারণত সামাজিক সম্মতি ছাড়াই ঘটে।
পৈতৃক বিবাহ (Paitrika Marriage):
এটি পাত্রীর বাবার দ্বারা পাত্রকে তার কন্যার জন্য নির্বাচন করার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
এটি প্রথাগত ও পারিবারিক বিবাহ।
সৈন্য বিবাহ (Sainya Marriage):
এটি এক সামরিক বা যোদ্ধা দ্বারা তার শক্তি ও কর্তৃত্বের কারণে ঘটানো হয়।
এই ধরনের বিবাহে যুদ্ধ বা দখল করা হতে পারে।
আপাধ (Apaadh Marriage):
এই বিবাহ সাধারণত একটি নারীর স্বামী মারা গেলে বা বিচ্ছিন্ন হলে ঘটে, যেখানে স্ত্রী অন্য একজন পুরুষকে গ্রহণ করে।
এটি শাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী ঘটে।
প্র্যাগ্রাহ বিবাহ (Pragrapha Marriage):
এটি গোপন বা লুকিয়ে থাকা বিবাহ, যেখানে দুই পক্ষের মধ্যে বিশেষ কোনও সামাজিক বাধা থাকে এবং তারা চুপিচুপি বিবাহ করে।
হিন্দু বিবাহের বিভিন্ন উপাদান বা উপাদানগুলি বিবাহের প্রক্রিয়া ও সংস্কৃতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই উপাদানগুলি বিভিন্ন ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দিক তুলে ধরে। নিচে হিন্দু বিবাহের মূল উপাদানগুলি উল্লেখ করা হল:
১. পাত্র-পাত্রীর সম্মতি (Consent of Bride and Groom)
বিয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল বর ও কনের সম্মতি। এটি সম্পর্কের ভিত্তি এবং দায়িত্ব গ্রহণের সংকল্প।
২. পবিত্র স্থান (Sacred Space)
বিয়ের অনুষ্ঠান সাধারণত একটি পবিত্র স্থানে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ধর্মীয় আচার ও অনুষ্ঠান পালন করা হয়।
৩. অগ্নির পূজা (Worship of Fire)
অগ্নি হিন্দু ধর্মে পবিত্র এবং সাক্ষী হিসেবে বিবেচিত। বর ও কনে অগ্নির চারপাশে ঘুরে নিজেদের একে অপরের সাথে যুক্ত করে।
৪. শপথ (Vows)
বিবাহের সময় বর ও কনে একে অপরকে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি ও শপথ গ্রহণ করে, যেমন সুখে-দুঃখে একসাথে থাকার প্রতিশ্রুতি।
৫. মাঙ্গলসূত্র (Mangalsutra)
কনে বর দ্বারা একটি বিশেষ মালা (মাঙ্গলসূত্র) পরিধান করে, যা বিবাহের পবিত্রতা ও সংহতির প্রতীক।
৬. আশীর্বাদ (Blessings)
বিবাহের সময় দুই পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে বর ও কনেকে আশীর্বাদ দেওয়া হয়, যা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের সুখ ও সমৃদ্ধি কামনা করে।
৭. সামাজিক রীতিনীতি (Social Customs)
বিভিন্ন সম্প্রদায় ও অঞ্চলের বিশেষ সামাজিক রীতিনীতি বিবাহের সময় পালন করা হয়, যা স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে।
৮. পূজা (Ceremonial Worship)
বিবাহের সময় বিভিন্ন ধর্মীয় পূজা ও আচার পালন করা হয়, যা বৈবাহিক সম্পর্ককে পবিত্র করে।
৯. বিবাহের অনুষ্ঠান (Wedding Festivities)
বিবাহের অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, যেমন নাচ, গান ও উৎসবের আয়োজন করা হয়।
১০. গ্রহণ (Griha Pravesh)
বিয়ের পরে কনে বর-দের বাড়িতে প্রবেশ করে, যা নতুন জীবনের সূচনা নির্দেশ করে।
বিবাহের বিভিন্ন পর্যায়
হিন্দু বিবাহের প্রক্রিয়া বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত, যা নিম্নরূপ:
পূর্ববর্তী প্রস্তুতি (Pre-wedding Preparations):
গুরুতর আলোচনা: বরের পরিবার ও কনের পরিবার মধ্যে প্রথম যোগাযোগ এবং আলোচনা।
মোহর (Muhurta): শুভ সময় নির্ধারণ করা হয়, যাতে বিবাহ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
বিবাহের আয়োজন: অতিথিদের আমন্ত্রণ, স্থান নির্ধারণ, খাবারের ব্যবস্থা ইত্যাদি।
বিবাহ অনুষ্ঠান (Wedding Ceremony):
মাঙ্গল ফোঁটন (Mangala Sutra): ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ও শিবের পূজা করা হয়, তারপর বর ও কনেকে একত্রিত করা হয়।
অগ্নি প্রয়োজন (Agni Pradakshina): বর ও কনে অগ্নির চারপাশে সাতবার ঘুরে নিজেদের একে অপরের সাথে বেঁধে নেয়।
শপথ গ্রহণ: পাত্র-পাত্রীর মধ্যে বিভিন্ন শপথ নেওয়া হয়, যেমন সুখ-দুঃখে একে অপরের পাশে থাকার শপথ।
পরবর্তী অনুষ্ঠান (Post-wedding Ceremony):
গ্রহণ (Griha Pravesh): কনে বর-দের বাড়িতে প্রবেশ করে এবং নতুন জীবনের শুরু হয়।
পূজা ও আশীর্বাদ: বর ও কনের পরিবার থেকে আশীর্বাদ গ্রহণ করা হয়।
সামাজিক বন্ধন: হিন্দু বিবাহ দুটি পরিবারের মধ্যে সামাজিক বন্ধন তৈরি করে, যা উভয় পরিবারের মধ্যে সহযোগিতা ও সমর্থন বৃদ্ধি করে।
উপসংহার
হিন্দু বিবাহ শুধুমাত্র একটি সামাজিক অনুষ্ঠান নয় বরং একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যা ইতিহাস, ধর্ম ও সমাজের সমন্বয়ে গঠিত। এটি প্রতিটি যুগে নতুন রূপে প্রকাশিত হয়েছে এবং সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছে। হিন্দু বিবাহের প্রথা এবং রীতি সমাজের মূল্যবোধ এবং পরিবারের সম্পর্ককে সুদৃঢ় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
লেখক
শামসুল আরেফিন।
শিক্ষার্থী আইন বিভাগ।
বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
মন্তব্য করার জন্য লগইন করুন!