স্টাফ রিপোর্টার
দেশের তিন প্রধান শহর—ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনা—বর্তমানে এক ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি। এই শহরগুলো এখন শুধু জনসংখ্যা বা অর্থনীতির জন্য নয়, বরং অপরাধের জন্যও শীর্ষস্থানে অবস্থান করছে। একসময় কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকা অপরাধ এখন পুরো শহর জুড়ে বিস্তার লাভ করেছে, আর সাধারণ নাগরিকেরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।
ঢাকায় অপরাধের বিস্তার, কিশোর গ্যাংয়ের রাজত্ব
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন—এই ছয় মাসে ৭ হাজার ৮২৭টি মামলা রেকর্ড হয়েছে। যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১৮ শতাংশ বেশি। সদরঘাট, মুগদা, যাত্রাবাড়ী, রূপনগর, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, রামপুরা ও মিরপুর এলাকা এখন অপরাধের হটস্পটে পরিণত।
বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, “শুধু পুলিশি অভিযান নয়, অপরাধ কমাতে হলে কমিউনিটি পুলিশিং, বিচারপ্রক্রিয়ার গতিশীলতা এবং তরুণদের জন্য গঠনমূলক কর্মসূচির বিকল্প নেই।”
মোহাম্মদপুরে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করছে কুখ্যাত কিলার বাদল ও কিলার লাল লাল্লু। তাদের মাধ্যমে সক্রিয় রয়েছে ঘাট বাবু, ভাঙ্গারি রনি, লম্বু মোশারফ, গ্যারেজ সোহেল, চাপাতি কাইয়ুমসহ একাধিক চিহ্নিত অপরাধী। এমনকি রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় এই গ্যাংয়ের সদস্যরা বসিলা গরুর হাটে নিরাপত্তার দায়িত্বও পালন করেছে।
গত ১৮ মে ও ২৭ মে চাপাতি কাইয়ুম ব্যবসায়ী আবু আলেম ও সাব্বির আহমেদের ওপর হামলা চালায়। কিন্তু ভয়ভীতির কারণে কেউ মামলা করতে সাহস পাননি।
মিরপুরের ভাসানটেক, কাফরুল, পল্লবী ও মিরপুর ১০, ১১ নম্বরে ইব্রাহিম, শাহাদত, মুক্তার, নজু, লালন, শাহীন ও মনার মাধ্যমে চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসা চলছে অবলীলায়।
চট্টগ্রাম: ইয়াবা, আইস আর কিশোর গ্যাংয়ের নগরীতে পরিণত
২০২৫ সালে চট্টগ্রামে অন্তত ১২০টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। ইয়াবা ও আইসের ছড়িয়ে পড়া মাদকে বিপথগামী হচ্ছে তরুণরা। ছিনতাই, হত্যা এবং সংঘবদ্ধ অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে তারা। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা কিশোর গ্যাং এখন জনমনে ভয় তৈরি করছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের প্রধান মৌমিতা পাল বলেন, “আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নিষ্ক্রিয়তা, রাজনৈতিক আশ্রয় এবং বেকারত্ব—এই তিনটি অপরাধ বাড়ানোর মূল কারণ। এর সমাধানে দরকার চাকরি, সুস্থ বিনোদন ও রাজনৈতিক স্বচ্ছতা।”
খুলনা: খুন, আধিপত্য আর চরমপন্থায় রক্তাক্ত শহর
একসময় চরমপন্থিদের ঘাঁটি ছিল খুলনা। কিন্তু এখন রীতিমতো রাস্তায় খুন হচ্ছে মানুষ। গত ১০ মাসে ২৭টি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ৮টি ঘটেছে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে। ২৭ জুন রূপসার রাজাপুরে তিন যুবককে গুলি করে, একজন নিহত হন। ১১ জুলাই যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, বিএনপি এটিকে রাজনৈতিক খুন বলে দাবি করছে।
এছাড়া ২৩ জানুয়ারি ময়লাপোতা মোড়ে সাদিকুর এবং ১৬ মার্চ চরমপন্থি নেতা শাহীনুল হক শাহীনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ৯ জানুয়ারি কক্সবাজার সৈকতে খুন হন খুলনার সাবেক কাউন্সিলর টিপু।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আবু রায়হান সালেহ বলেন, “পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে মাঠে ফের সক্রিয় হওয়াই ছিল চ্যালেঞ্জ। এখন আমরা আগের চেয়ে বেশি সক্রিয়ভাবে কাজ করছি।”
দেশের তিনটি প্রধান শহরে অপরাধের গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী। সমাজের প্রতিটি স্তরের—আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিচারব্যবস্থা, রাজনীতি, পরিবার ও তরুণ সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। না হলে এই শহরগুলো অচিরেই ‘অপরাধের রাজধানী’ তকমা পেয়ে যাবে।
মন্তব্য করার জন্য লগইন করুন!