জনপ্রিয় উপস্থাপক সামিয়া আফরিন প্রায় তিন বছর ধরে কোলন ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করছেন। দীর্ঘদিন পরিবার ও কাছের বন্ধুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তাঁর এই অসুস্থতার খবর। তবে সম্প্রতি একটি চ্যারিটি পোশাক প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে নিজের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার গল্প প্রথমবারের মতো সবার সামনে তুলে ধরেন তিনি।
ক্যানসারের রোগীদের সহায়তায় বিশেষ আয়োজন
২০ মার্চ ঢাকার বনানীতে 'রিভোগ ওয়্যার টু কেয়ার' নামে তিন দিনব্যাপী একটি পোশাক প্রদর্শনী আয়োজন করা হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ। এই আয়োজনে সামিয়া আফরিন জানান, তিনি গত দুই বছর সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিয়েছেন এবং বর্তমানে কোনো ওষুধ বা থেরাপি নিচ্ছেন না।
সামিয়া বলেন, "সবাই জানতে চাইছিলেন, কেন আমি ক্যানসার রোগীদের জন্য এমন আয়োজন করছি। বাধ্য হয়েই জানালাম, আমি নিজেই এই রোগের শিকার"। তিনি আরও বলেন, "এই কঠিন সময়ে উপলব্ধি করেছি, ক্যানসার শুধু শারীরিক নয়, মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবেও বিশাল এক চ্যালেঞ্জ। অনেকেই চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে পারেন না। তাই চেয়েছি, ক্যানসার রোগীদের পাশে দাঁড়াতে"।
ক্যানসার ধরা পড়ার পর
২০২২ সালের এপ্রিলে সামিয়া নিজের শরীরে অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ করেন এবং পরীক্ষা করানোর পর জানতে পারেন, তাঁর কোলন ক্যানসার হয়েছে। ঢাকায় চিকিৎসকদের পরামর্শে দ্রুত সিঙ্গাপুরে যান তিনি।
তবে প্রথমে নিজের রিপোর্ট বিশ্বাস করতে পারেননি সামিয়া। তিনি বলেন, "আমি স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করি, নিয়মিত জিম করি, সঠিক খাবার খাই—তাহলে আমার কেন ক্যানসার হবে? মনে হচ্ছিল, কোথাও একটা ভুল হচ্ছে"।

কিন্তু সিঙ্গাপুরে পরীক্ষার পর জানা যায়, এটি চতুর্থ ধাপের ক্যানসার এবং এর জীবাণু ছড়িয়ে পড়েছে ফুসফুস ও লিম্ফ নোডসে। চিকিৎসকরা জানান, অস্ত্রোপচারের পর তাঁকে একটি বিশেষ ব্যাগ বহন করতে হবে। এ কথা শুনে ভেঙে পড়েছিলেন সামিয়া।
তিনি বলেন, "আমি ভাবতে পারছিলাম না, আমার পুরো জীবনধারা বদলে যাবে! মনে হচ্ছিল, আমি কোনো চিকিৎসাই করাব না। ভাগ্যে যা আছে, তা-ই হবে। কিন্তু পরে ইমিউনো থেরাপি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই"।
সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার দিনগুলো
সিঙ্গাপুরের সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকরা তাঁকে ইমিউনো থেরাপি গ্রহণের পরামর্শ দেন। এই পদ্ধতিতে ক্যানসারের বিরুদ্ধে শরীরে নিজস্ব প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হয়, তবে এটি খুব ব্যয়বহুল এবং দুর্লভ চিকিৎসাপদ্ধতি।
সামিয়া বলেন, "প্রথম কয়েক মাস খুব কষ্ট হতো। এতটাই দুর্বল হয়ে পড়তাম যে ১০ কদম হাঁটতেও কষ্ট হতো। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম, জীবন স্বাভাবিক থাকুক। ওষুধ নিয়ে এসেও বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছি, অনুষ্ঠান করেছি"।
বন্ধুদের পাশে থাকার গল্প
ক্যানসারের কঠিন সময়েও নিজেকে ভেঙে পড়তে দেননি সামিয়া। তিনি বলেন, "মানসিকভাবে ভাবতে চাইনি যে আমি অসুস্থ। তাই কাজ করেছি, অফিস করেছি, ক্লান্ত হলে বিশ্রাম নিয়েছি"।
এই সময় তাঁর বন্ধু বাপ্পা মজুমদার, পার্থ বড়ুয়া, তানিয়া হোসাইনসহ অনেকেই পাশে ছিলেন। তাঁরা সবসময় মানসিকভাবে উৎসাহ দিয়েছেন এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনে সাহায্য করেছেন।
এখন কেমন আছেন?
দুই বছরের চিকিৎসা শেষ হওয়ার পর সামিয়ার শরীরে ক্যানসারের জীবাণু আর ছড়াচ্ছে না। তিনি বলেন, "এটা অলৌকিক হোক বা চিকিৎসার প্রভাব, জানি না। তবে গত সাত-আট মাস ধরে আমি কোনো ওষুধ নিচ্ছি না"।
তবে ক্যানসারের চতুর্থ ধাপের রোগী হওয়ায় এখনো ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। সামিয়া বলেন, "জানি না, কখন কী হবে। তবে এখন আগের চেয়ে ভালো আছি, স্বাভাবিক জীবনযাপনের চেষ্টা করছি"।
ক্যানসার সচেতনতায় আরও উদ্যোগ নেবেন
সামিয়া আফরিন মনে করেন, ক্যানসার নিয়ে লজ্জা বা ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তিনি বলেন, "আগে মানুষ এই রোগের কথা মুখেও আনত না। কিন্তু এখন প্রায় প্রতিটি পরিবারে কেউ না কেউ ক্যানসারে আক্রান্ত"।
তাই ভবিষ্যতে ক্যানসার সচেতনতায় আরও উদ্যোগ নিতে চান তিনি। তাঁর পরিকল্পনা, রোগীদের জন্য আরও অর্থসহায়তার ব্যবস্থা করা এবং সচেতনতা বাড়ানো।
"জীবন কঠিন, কিন্তু থেমে গেলে চলবে না। লড়াই চালিয়ে যেতে হবে,"—এভাবেই নিজের সংগ্রামের গল্প শেষ করেন উপস্থাপক সামিয়া আফরিন।
মন্তব্য করার জন্য লগইন করুন!