মানুষ আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “অবশ্যই আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম অবয়বে।” (সূরা ত্বীন, আয়াত: ৪)। আর এই পৃথিবীতে আল্লাহর দেওয়া নেয়ামতের মধ্যে অন্যতম হলো সন্তান।
কিন্তু অনেকেই দারিদ্রের ভয় বা রিজিকের সংকটের আশঙ্কায় সন্তান জন্মদান রুখে দিতে চান। এমনকি কেউ কেউ স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণের পথও বেছে নিচ্ছেন। অথচ ইসলাম এই বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে এবং সুস্পষ্টভাবে গাইডলাইন দিয়েছে।
জন্মনিয়ন্ত্রণের স্থায়ী পদ্ধতি: ইসলাম কী বলে?
জন্মনিয়ন্ত্রণের তিনটি পদ্ধতি রয়েছে:
এক. জন্মনিয়ন্ত্রণের স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যার দ্বারা নারী বা পুরুষ প্রজনন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
দুই. অস্থায়ীভাবে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যার ফলে স্বামী-স্ত্রীর কেউ প্রজনন ক্ষমতাহীন হয়ে যায় না। যেমন, কনডম ব্যবহার করা, পিল সেবন করা ইত্যাদি।
তিন. গর্ভধারণের পর গর্ভপাত ঘটানো।
প্রথম পদ্ধতিটি গ্রহণ করা সম্পূর্ণ নাজায়েজ। কেননা এতে আল্লাহর সৃষ্টির পরিবর্তন করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। তবে এক্ষেত্রে কখনও কোনো অভিজ্ঞ দ্বীনদার ডাক্তারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গর্ভধারণের কারণে মায়ের প্রাণনাশের আশঙ্কা হলে স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করা যেতে পারে।
আর দ্বিতীয় পদ্ধতি শুধু নিম্নোক্ত ক্ষেত্রে জায়েজ হবে। বাচ্চার জন্মের মাঝে কিছুসময় বিরতি দেয়া, যাতে প্রথম সন্তানের লালনপালন, পরিচর্যা ঠিকমতো হয়। কোনো কারণে মহিলার বাচ্চা লালন-পালনের সামর্থ্য না থাকলে। মহিলা অসুস্থ ও দুর্বল হওয়ার কারণে গর্ভধারণ বিপজ্জনক হলে।
তবে ভালোভাবে মনে রাখা দরকার যে, এসব ক্ষেত্রে বৈধতা শুধু ব্যক্তিগত প্রয়োজনে। সম্মিলিতভাবে মানুষের কাছে প্রচারণা করা ও এতে উদ্বুদ্ধ করা কোনোভাবেই জায়েজ নয়। আর তৃতীয় পদ্ধতিও নাজায়েজ। তবে যদি মহিলা অত্যধিক দুর্বল হয়, যার কারণে গর্ভধারণ তার প্রাণনাশের আশঙ্কাজনক হয় আর গর্ভধারণের মেয়াদ চার মাসের কম হয়, তাহলে গর্ভপাত বৈধ হবে। আর মেয়াদ চার মাসের অধিক হলে বৈধ নয়। (মুসলিম শরিফ ২/৩১৯, জাদিদ ফিকহি মাবাহেস ১/২৮২)
কখন অস্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ বৈধ?
ইসলাম শুধুমাত্র ব্যক্তিগত প্রয়োজন ও সীমিত ক্ষেত্রে অস্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণকে বৈধতা দিয়েছে। যেমন:
সন্তান জন্মের মাঝে কিছুটা বিরতি প্রয়োজন হলে,
প্রথম সন্তানকে যত্নের মাধ্যমে বড় করে তোলার সময় প্রয়োজন হলে,
মহিলার শারীরিক দুর্বলতার কারণে গর্ভধারণ বিপজ্জনক হলে।
তবে এই পদ্ধতির প্রচার বা উৎসাহ দেওয়া ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী অবৈধ।
কোরআন ও হাদিসে কী বলা হয়েছে?
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন,
“তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না দারিদ্রের কারণে, আমিই তোমাদের রিজিক দান করি এবং তাদেরও।” (সূরা আন’আম, আয়াত: ১৫১)
হাদিস শরিফে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন—
“আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বড় গুনাহ হলো, সন্তানকে এ আশঙ্কায় হত্যা করা যে সে তোমার খাবার ভাগ করে নেবে।” (তিরমিজি: ৩১৮২)
সন্তান মানে বোঝা নয়, বরং বরকত
সন্তানের জন্ম বন্ধ করা মানেই আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাস প্রকাশ করা। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, সাহাবায়ে কেরাম গনিমতের দাসীদের সঙ্গে মিলনের সময় ‘আজল’ (সন্তান না হওয়াতে সহায় একটি পদ্ধতি) করতেন, কিন্তু রাসুল (সা.) তাদের এ কাজ সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এবং বলেন—
“কিয়ামত পর্যন্ত যে আত্মা জন্মাবে, তা জন্মাবেই।” (বুখারি: ৫২১০)
এখানে স্পষ্ট যে, সন্তান জন্ম দেওয়া বা না দেওয়ার নিয়ন্ত্রণ একমাত্র আল্লাহর হাতে।
আলেমদের দৃষ্টিতে সমাধান কী?
বর্তমান সময়ে কেউ কেউ ভবিষ্যতের দারিদ্রের আশঙ্কায় জন্মনিয়ন্ত্রণের পথ বেছে নেন। কিন্তু ইসলাম বলছে—রিজিক আল্লাহর হাতে। সন্তান জন্মালে তার রিজিকও তিনিই দেবেন।
যদি মহিলার অবস্থা এমন হয় যে, প্রতি সন্তান জন্মের সময় তার জীবন হুমকির মুখে পড়ে এবং চিকিৎসকরা স্থায়ীভাবে সন্তান নেওয়া বন্ধ করতে বলেন, তাহলে আলেমগণ এমন সিদ্ধান্তকে শর্তসাপেক্ষে বৈধ বলেছেন।
অন্যদিকে, সাময়িক বিরতি বা সন্তান নিতে দেরি করা যদি মা ও শিশু দুজনের কল্যাণে হয়, তাহলে সেটা ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে অনুমোদিত হতে পারে।
মন্তব্য করার জন্য লগইন করুন!