মতাদর্শের বিভেদ, রাজনৈতিক সংকট ও সংস্কৃতির ওপর অযাচিত অভিঘাতের বিপরীতে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও সঙ্গীত বাঙালিকে বারবার উদার, মানবিক ও সহিষ্ণু হতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। এই মশাল জ্বালিয়ে তিন দিনের জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন শেষ হলো গতকাল।
শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ধানমন্ডির ছায়ানট ভবনের মিলনায়তনে সমাপ্তি অধিবেশনের আয়োজন করা হয়। বিকেলে অনুষ্ঠিত হয় সম্মেলনের বিশেষ পর্ব, যেখানে সদ্য প্রয়াত বরেণ্য রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী পাপিয়া সারোয়ারকে মরণোত্তর ‘রবীন্দ্রপদক ও গুণী সম্মাননা’ প্রদান করা হয়। এই পদক গ্রহণ করেন তাঁর জীবনসঙ্গী সারোয়ার আলম। পদক প্রদানকালে তিনি বলেন, “শ্রোতাদের হৃদয়ে গানের মধ্য দিয়েই চিরকাল বেঁচে থাকবেন শিল্পী পাপিয়া সারোয়ার।”
সম্মেলনের প্রধান অতিথি বরেণ্য শিল্পী রফিকুন নবী পদক তুলে দিয়ে বলেন, “রবীন্দ্র সম্মেলন শুধু সংগীত পরিবেশনার আয়োজন নয়, এটি বাঙালির সংস্কৃতি ধারণ করার মঞ্চ। আমাদের রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে অন্যদের রবীন্দ্রনাথের তফাত রয়েছে। ষাটের দশক থেকেই আমরা তাঁকে ভিন্নভাবে ধারণ করেছি।”
সমাপনী অধিবেশনে পরিষদের সভাপতি মফিদুল হক বলেন, “দেশ আজ সম্ভাবনা ও সংকটের দোলাচলে। তবু আমরা বিশ্বাস করি, মানবতার শক্তি দিয়ে সব বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যাব। এক মশাল থেকে জ্বলে উঠবে বহু মশাল।” তিনি উল্লেখ করেন, বাউল লালনের সম্প্রীতি আক্রমণের শিকার হলেও এই সম্মেলনের আয়োজন সে চেতনারই উত্তরাধিকার বহন করে।
এবারের সম্মেলনে প্রয়াত শিল্পী পাপিয়া সারোয়ারের পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁর নামে একটি ট্রাস্ট গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। পরিবারের পক্ষ থেকে অর্থমূল্য প্রদানের ঘোষণাও দেওয়া হয়।
সম্মেলনের সাধারণ সম্পাদক শিল্পী লিলি ইসলাম সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “এই আয়োজন একত্রিত হওয়ার, সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধতার এক অনন্য উদাহরণ।”
তিন দিনের এ আয়োজনে জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন পরিষদের ৬২টি শাখার পাঁচ শতাধিক শিল্পী, সংগঠক, ও কর্মী অংশগ্রহণ করেন। প্রথম দিন বোধনসংগীত “এই কথাটা ধরে রাখিস—মুক্তি তোরে পেতেই হবে” পরিবেশনার মাধ্যমে সম্মেলন শুরু হয়। দ্বিতীয় দিনে সাংস্কৃতিক আয়োজনের পাশাপাশি অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রবন্ধ পাঠ।
শেষ দিনে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের মাধ্যমে দিন শুরু হয়। বিকেলে শ্যামলীর এসওএস শিশুপল্লিতে আয়োজন করা হয় বিশেষ সংগীত অনুষ্ঠান। সন্ধ্যায় সমাপনী অধিবেশনে প্রদীপ প্রজ্বালন, সংগীত পরিবেশনা, নৃত্য ও আবৃত্তির মধ্য দিয়ে জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলনের ৪৩তম বার্ষিক আয়োজনের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে।
এই আয়োজনের প্রতিটি মুহূর্ত যেন প্রমাণ করে—সংস্কৃতির মশাল হাতে বাঙালির যাত্রা কোনো বাধায় থেমে থাকবে না।
মন্তব্য করার জন্য লগইন করুন!