আবু রাসেল সুমন ব্যাুরো প্রধান:খাগড়াছড়ি।।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী জনগোষ্ঠী বা অন্যন্যা সম্প্রাদায় মানুষের কাছে সবচেয়ে অন্যতম জনপ্রিয় সুস্বাদু খাবারের নাম কাষ্ঠল চিরহরিৎ একটি উদ্ভিদ "বাঁশ" যার মূল থেকে বের হওয়া ছোট ছোট কচি অংশকে বলা হয় "বাঁশ কোড়ল (Bamboo shoots) যা পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের কাছে পরিচিত একটি নাম।
পাহাড়ের গহিন অরন্যে প্রাকৃতিকভাবে ও কারো নিজেস্ব বাগানে পাহাড়ের ঢালুতে পরিচর্চাহীন অবস্থায় জন্ম নেয় বাঁশ । প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো এসব বাঁশই তিন বছর পর পরিপূর্ণ বাঁশে পরিণত হয়ে কর্তন ও ব্যবহার উপযোগী হয়।
সাধারণত বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাঁশ থেকে ঝুড়ি, মাছ ধরার পলো, হাঁস-মুরগির খাঁচা, শিশুদের দোলনা, বেড়া, চাটাই, কুলা, ডালা, হাতপাখা, কাগজ,
এবং এমনকি ঘরবাড়ি তৈরি করার কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
বনের গহীনে বা নিজের বাগান থেকে সংগ্রহ করা এসব বাঁশ পরিণত হওয়ার আগেই স্থানীয় পাহাড়িরা বাঁশ গাছের গোড়ার কচি অংশ সংগ্রহ করে তা প্রতিদিন স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে আসে।
এই বর্ষা মৌসুমে পার্বত্য এলাকার বিভিন্ন বাজারগুলোতে জনপ্রিয় সবজি হিসেবে সব চেয়ে বেশি দেখা মেলে "বাঁশ কোড়ল"। বিক্রেতাদের বিভিন্ন সবজির মধ্যে প্রধান সবজি হিসেবে খ্যাত" বাঁশ কোড়ল" পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের সবজির তালিকায় পছন্দের একটি সবজি হিসেবে রাখা হয়।
পার্বত্য এ পাহাড়ী জনপদে বাঁশ কোড়ল বিভিন্ন নামে বা ভাষায় পরিচিত। ত্রিপুরা ভাষায় "মেওয়া"।
মারমা ভাষায় "মহ্ই"। চাকমা ভাষায় "বাচ্ছুরি" আর অন্যন্যা সম্প্রদায়ের মানুষের নিকট "বাঁশ কোড়ল" নামে বেশ পরিচিত।
সব বাশের কোড়ল খাওয়া যায় না। যেগুলো খাওয়া যায় তার মধ্যে সব চেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে মুলি বাঁশের কোড়ল। রয়েছে - ডলু বাঁশ, মিতিংগ্যা বাঁশ, ফারুয়া বাঁশ, বাজ্জে বাঁশ, ও কালিছুরি জাতের "বাঁশ কোড়ল"। এসব প্রজাতি বাঁশের কোড়ল খেতে বেশ সুস্বাদু। যা স্হানীয় পাহাড়ি বাজারে কেজি প্রতি ৬০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রয় করা হয়।
খাগড়াছড়িসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার হাট বাজারে দেখা মিলছে এই বাঁশ কোড়লের। দুর দুরান্ত থেকে পাহাড়ি বিক্রেতারা এগুলো সংগ্রহ করে বাজারে নিয়ে আসছে। এই বাঁশকোড়ল পাহাড়িদের পাশাপাশি বাঙালীদের কাছেও একটি জনপ্রিয় খাবার।
বর্তমানে পারিবারিক চাহিদা মিটিয়ে স্থানীয় হোটেল ও রেস্টুরেন্টগুলোতেও জনপ্রিয়তা পেয়েছে এ সবজি। খাগড়াছড়ির নানা পর্যটনে ঘুরতে আসা পর্যটকদেরও অন্যতম আকর্ষণ "বাঁশ কোড়ল"
বছরের মে থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত এ সবজির ভরা মৌসুম থাকে। মুলি বাঁশ, ডলু বাঁশ, মিতিঙ্গ্যা বাঁশ, ফারুয়া বাঁশ, বাজ্জে বাঁশ, কালিছুরি বাঁশসহ বেশ কয়েক প্রজাতির বাঁশ কোড়ল পাওয়া যায় স্থানীয় বাজারগুলোতে। প্রত্যন্ত এলাকার দরিদ্র কিছু মানুষ এই বাঁশ করুল বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। বর্ষার শুরুতে বৃষ্টির পানিতে মাটি নরম হলে এটি বাড়তে শুরু করে। মাটি হতে ৪-৫ ইঞ্চি গজিয়ে উঠলে এটি খাওয়ার উপযোগী হয়। জাতের ভিন্নতার সাথে সাথে বাঁশ কোড়লের স্বাদেও ভিন্নতা রয়েছে।
বাজারে বিক্রয় করতে আসা কল্পনা ত্রিপুরা বলেন, প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে উচু নিচু পাহাড় বেয়ে বনের গহিনে গিয়ে খুঁজে খুঁজে "বাঁশ কোড়ল" সংগ্রহ করতে হয়। এগুলো পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে বিক্রির উপযোগী করে তা বিকালে বাজারে এনে কখনো চারশ, কখনো পাঁচ-ছয়শ টাকার বাঁশ কোড়ল বিক্রি করেন। সেই টাকা দিয়ে পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনে নিয়ে যান। বাঁশ কোড়ল বিক্রির আয়ের টাকায় পরিবার চলে বলে জানান তিনি।
"বাঁশ কোড়ল" কিনতে আসা ক্রেতা সুমনা চাকমা বলেন, বাজারে আসলেই প্রথমে আমার পছন্দের এই সবজিটি খুজি। এটি বেশ সুস্বাদু খাবার। বিশেষ করে বাঁশ কোড়ল বিভিন্ন পদ্ধতিতে রান্না করা যায়। তার মধ্যে ডাল দিয়ে রান্না, মাংস দিয়ে রান্না কিংবা ভাজি করে খাওয়ার মজাই আলাদা। তারা অনেকেই বাঁশ কোড়ল কিনে সিদ্ধ করে ফ্রীজে মজুদ করে ও খেয়ে থাকেন বলে জানান।
তাজা বাঁশ কোড়লে রয়েছে, ৮৮ - ৯৩% পানি, ০, ৭৮-৫.৮৬%চিনি, ১,৫-৪% প্রোটিন, ০,২৫-০,৯৫% চর্বি, ০,৬০-১,৩৪% সেলুলোজ, ১,১% খনিজ পদার্থ এবং
পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিনের পাশাপাশি রয়েছে অনেক উপকারিতা। যেমন:- হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়, দেহের কোলেস্টরেলের মাত্রা কমায়। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। ক্যানসারের ঝুঁকিও কমায়। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। হাঁপানি, ডায়াবেটিস, তীব্র জ্বর, মূর্ছা যাওয়া, মৃগী রোগ ইত্যাদি নিরাময়ে যথেষ্ট উপকার করে এবং হজমজনিত সমস্যা দুর করণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
নানা ধরণের সবজির মধ্যে "বাঁশ কোড়ল"কোনো অংশেই কম নয়। বরং, এর উপকারিতা অনেক। নিয়মিত বাঁশ কোড়ল খেলে মানবদেহের নানা রোগের প্রতিষেধক হিসেবে এর কার্যকারিতা অপরিসীম।
পাহাড়ের জনপ্রিয় সবজি হলেও পরিকল্পিত ভাবে বাঁশের কচি মূল গুলো কেটে ফেলার কারণে ও বাঁশ গাছে বীজ আসায় দিন দিন উজার হচ্ছে বাঁশঝাড়। যার ফলে আজ বিলুপ্তের পথে পাহাড়ের বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ।
মন্তব্য করার জন্য লগইন করুন!